স্বদেশ ডেস্ক: দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের ১৫ মাস পার হলেও এখনো সব জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্তমানে ৩০টি জেলায় আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিসহ মোট ৪৬টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বাকি ১৮টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। ফলে এসব জেলার বাসিন্দাদের আরেক জেলায় গিয়ে বা তাদের নমুনা আরেক জেলায় পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগীরা এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত করায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। যাদের নমুনা পাঠানো হচ্ছে, তাদের দেরি হচ্ছে পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেও। ফলে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।
জানা গেছে, দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর প্রথম দিকে ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মাদারীপুর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ে সংক্রমিত জেলাগুলোয় পরীক্ষাকেন্দ্রে চালু করা হয়। তখন যেসব জেলায় সংক্রমণ একেবারে কম ছিল এখন সেখানে, বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী ও আশপাশের জেলাগুলোয় সংক্রমণ খুবই বেশি। এসব জেলায় আবার তীব্র সংক্রামক করোনা ভারতীয় ধরন বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্ট, নাইজেরিয়া ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। অথচ এসব জেলার অনেকগুলোয় করোনার পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও কেন জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা গেল না, সেটির জবাবও নেই কারও কাছে। আর পরীক্ষা কম হওয়ায় সন্দেহভাজন অনেক রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের এক বছরের বেশি সময় পার হয়েছে গেছে। এখনো সব জেলায় করোনা টেস্টের সেন্টার চালু করা হয়নি, এটি একটি বড় ঘাটতি। সংক্রমণ প্রতিরোধে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করে আইসোলেশন, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজে অবহেলা করলে হবে না। আমরা পরীক্ষার ব্যবস্থা বাড়ানোর সুপারিশ করেছি। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব জেলায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, সেখানকার কারও পরীক্ষার প্রয়োজন হলে তাকে আরেক জেলায় যেতে হয় বা তার নমুনা সংগ্রহ করে পাঠাতে হয়। যারা পরীক্ষার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন, তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আর যাদের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো বা অন্য কোনো দূরের জেলায় পাঠানো হচ্ছে, তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে রিপোর্ট ভুল আসতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের তথ্যমতে, দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয়। এর পর প্রথম দিকে পরীক্ষা কার্যক্রম ও রোগীর শনাক্ত কম হলেও দিনে দিনে এটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ওই সময়ে শুধু পরীক্ষা কার্যক্রম আইইডিসিআরের সীমাবদ্ধ রাখায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে একই বছরের মার্চের শেষ দিকে পরীক্ষার কেন্দ্র বাড়াতে শুরু করে সরকার। প্রথমে পরীক্ষাকেন্দ্র ঢাকায় বাড়ানো হলেও পর্যায়ক্রমে সারাদেশে বাড়ানো হয়। বর্তমানে সারাদেশে ১৩২টি আরটি-পিসিআর, ৪৬টি জিনএক্সপার্টসহ মোট ১৭৮টি ল্যাব আছে। এ ছাড়া আরও ৩৩৪টি স্থানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। তথ্য বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৬টি জেলায় আরটি-পিসিআর ও জিনএক্সপার্ট পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলেও ১৮টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। যেসব জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই তার মধ্যে রয়েছে- মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, শেরপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, লক্ষ্মীপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার।
জেলাভিত্তিক নমুনা পরীক্ষা এবং রোগী শনাক্তের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই এমন কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ হার বেশি। পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকায় এসব জেলার বাসিন্দাদের বাধ্য হয়ে অন্য জেলায় যেতে হচ্ছে। অনেক দূরের যাত্রা বিধায় উপসর্গ থাকলেও অনেকে পরীক্ষা করতে যেতে চান না। আবার যাদের নমুনা এক জেলা থেকে আরেক জেলায় পাঠানো হচ্ছে। দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে এসব জেলায় নমুনা পরীক্ষার ফল পেতেও সময় বেশি লাগছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরে করোনার সংক্রমণ হার কমলেও সীমান্তবর্তী ও তার আশপাশের জেলাগুলোয় সংক্রমণ খুবই বেশি। কোনো কোনো জেলায় সংক্রমণ হার ৬৫ শতাংশ বা তারও বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা বিভাগে সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলায় আরটি-পিসিআর ল্যাব নেই। বাকি ছয়টি জেলার মধ্যে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাজীতে আরটি-পিসিআর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে জিনএক্সপার্ট পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার মধ্যে চারটিতে আরটি-পিসিআর ও ছয় জেলায় জিনএক্সপার্ট পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১২টি জেলার মধ্যে আটটিতে আরটি-পিসিআর ও জিনএক্সপার্ট পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলেও মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার মধ্যে তিনটিতে আরটি-পিসিআর থাকলেও শেরপুর জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে নয়টিতে আরটি-পিসিআর ল্যাব থাকলেও বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও লক্ষ্মীপুর জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার মধ্যে পাঁচটিতে আরটি-পিসিআর ও জিনএক্সপার্ট ল্যাব থাকলেও ঝালকাঠি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। সিলেট বিভাগের চারটি জেলার মধ্যে একটিতে পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলেও সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে নেই পরীক্ষাকেন্দ্র।
এদিকে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। আগের দিন সকাল থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৩ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষায় নতুন ৩ হাজার ৯৫৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। মারা গেছেন আরও ৬০ জন। নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ নিয়ে দেশে ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৭৮৬টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭ জন। মোট নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। মোট মারা গেছেন ১৩ হাজার ২৮২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৩৬ জন পুরুষ এবং ২৪ জন নারী। এর মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ২৩ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১০ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ১ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৩ জন রয়েছেন। মৃতদের অঞ্চল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে ৮ জন, চট্টগ্রামে ৮, রাজশাহীতে ১৭, খুলনায় ১৪, সিলেটে ৬, রংপুরে ৪ ও ময়মনসিংহে ৩ জন রয়েছেন।